Header Ads Widget

বৈলর জমিদার বাড়ি, ময়মনসিংহ । Bailar Jamindar House

 বিখ্যাত জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী মনোরঞ্জনের জন্য ত্রিশাল উপজেলার বৈলর ইউনিয়নে সুতিয়া নদীর তীর ঘেঁষে ১০ একর জমির ওপর নির্মাণ করেছিলেন এক রঙ্গশালা। পূজাপার্বন ছাড়াও কলকাতার নামীদামি শিল্পীদের এখানে নিয়ে আসতেন নাচ-গানের জন্য। হেমচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর ১৯৪৬ সালে দেশ ভাগের সময় তার উত্তরসূরীরা সাম্প্রদায়িক হামলার ভয়ে ভারতে পাড়ি জমান। কিন্তু জন্মভূমির মায়া ছাড়তে না পেরে হেমনগরে থেকে যান তার দুই উত্তরসূরী শ্যামকান্ত গাঙ্গুলী ও কমল গাঙ্গুলী। পরে ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারাও দেশ ত্যাগ করেন। এরপর জবরদখলকারীদের হাতে জমিদার বাড়ির সম্পদ ও একাধিক ভবনের নির্মাণশৈলী ও নিপুন কারুকার্য ধ্বংস হতে থাকে। ইতিহাসে কালের সাক্ষী হয়ে ঠাঁই দাড়িয়ে থাকা জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর সেই রঙ্গশালা আজ প্রায় নিশ্চিহ্নের পথে।  

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আদি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর নকশা খচিত কাঠের তৈরি বৈলর জমিদার বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে ‘রংমহল’ নামে পরিচিত। ১৫০ বছর আগের এই নিদর্শন এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে।

ময়মনসিংহ শহর থেকে এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার এবং ত্রিশাল থেকে দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। নান্দনিক নকশা খচিত দ্বিতল বাড়িটি পড়ে রয়েছে অযত্নে-অবহেলায়।

জানা যায়, ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের দক্ষিণ অঞ্চল পরিচালিত হতো বৈলর জমিদার বাড়ি থেকে। তখন থেকেই ত্রিশালের বৈলর প্রসিদ্ধ ছিল।

বৈলর নামকরণ হয় জমিদারি আমলে। এর নামকরণের কারণ হলো ময়মনসিংহ দক্ষিণের বৈলরের লোকজন তৎকালীন লেখাপড়া করার বেশি সুযোগ পেত। তখনকার লোকজন বই একটার পর একটা লর বেঁধে রাখত তাই বইয়ের লর কথাটি পরবর্তীতে বইলর হয়ে যায়। আর এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বৈলর নামে।




১৮৩০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামের কালীচন্দ্র রায়ের ঘরে জন্মগ্রহন করেন জমিদার হেমচন্দ্র রায়। কালীচন্দ্র রায় ছয় আনার তালুক (ভূসম্পত্তির) মালিক ছিলেন। তার মৃত্যুর পর হেমচন্দ্র রায় মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত রায়ের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে জয়েনশাহী পরগনার পাঁচ আনা আড়াই গন্ডা তালুক (পরিমানে প্রায় ৮৫ হাজার একর) নিলামে ক্রয় করেন। সেসময়ে হেমচন্দ্র রায়ের জমিদারি আমবাড়িয়া থেকে উত্তর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জসহ প্রায় চার লাখ একরে প্রসারিত হয়। লাভ করেন চৌধুরী উপাধি। 



সংস্কৃতির সমঝদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী একদা সুতিয়া নদী ধরে এসেছিলেন নৌভ্রমনে। ঘুরতে এসে সুতিয়া নদীর তীর ঘেঁষা নিরিবিলি পরিবেশের ত্রিশালের বৈলর ইউনিয়নের হিন্দুপল্লী এলাকাটি তার খুব পছন্দ হয়। সেখানে ওই প্রভাবশালী জমিদার তার মনোরঞ্জনের জন্য ১০ একর জমির চারপাশে সুউচ্চ প্রাচীরে ঘেরা এক রঙ্গশালা নির্মাণ করেছিলেন। পূজাপার্বন ছাড়াও নাচ গানের জন্য কোলকাতা থেকে নামীদামি শিল্পীদের নিয়ে আসতেন এখানে।

বাড়ির ভেতরে ছিল নির্মাণশৈলীর সুনিপুণ নকশা ও কারুকার্যের কাঠের তৈরি ১০টি দ্বিতল স্থাপনা। নাচঘর, রংমহল ও নাট্যঘরসহ সেখানে ছিল সুবিশাল পুকুর, মিনি চিড়িয়াখানা, কারাগার ছাড়াও আরো অনেক কিছু। শৈল্পিক অবকাঠামোর ওই বাড়িটি একসময়ে জমিদার হেমচন্দ্রের খুব প্রিয় এবং বিলাসিতার স্থান ছিল। জমিদারি কাজের ফাঁকে অবসর কাটাতে প্রায়ই তিনি ওই বাড়িতে রাত্রী যাপন করতেন। কখনও রাজকীয় পানসি নৌকায়, কখনও বা ঘোড়ার গাড়ি চেপে আসতেন ওই বাড়িতে।   

বাড়িটি দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন জমিদারের বিশ্বস্ত কর্মচারি দেবেন্দ্রনাথ সিং। কুচবিহারের বাসিন্দা নিঃসন্তান দেবেন্দ্রনাথ সিং রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর জমিদার বাড়ি চলে যায় স্থানীয়দের দখলে। মূল্যবান অনেক সম্পদ চুরি হয়ে যাওয়া ও সম্পদ বেহাত হওয়াতে একের পর এক নির্মাণশৈলী ও নিপুন কারুকার্যমন্ডিত ভবন ধ্বংস হতে থাকে। কালের স্বাক্ষী হয়ে একটি মহল আজও ঠাঁয় দাড়িয়ে থাকলেও প্রায় নিশ্চিহেৃর পথে জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরীর সেই রঙ্গশালা।   
 
স্থানীয়রা জানায়, ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিখ্যাত হুমগুটি খেলাটির প্রচলন করেছিলেন জমিদার হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী। শত বছরের সেই ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন স্থানীয়রা। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষের ভিড় জমে ওই হুমগুটি খেলা দেখতে। দানবীর ও শিক্ষানুরাগী হেমচন্দ্র চৌধুরী বাংলাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পাশাপাশি ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রেখেছিলেন। ১৯২৫ সালে ৯২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন হেমচন্দ্র রায় চৌধুরী। 

ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলার আদি নিদর্শন হিসেবে উল্লেখযোগ্য জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর নকশা খচিত কাঠের তৈরি বৈলর জমিদার বাড়ি। স্থানীয়দের কাছে ‘রংমহল’ নামে পরিচিত। ১৫০ বছর আগের এই নিদর্শন এখন জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে রয়েছে।

ময়মনসিংহ শহর থেকে এর দূরত্ব ১৫ কিলোমিটার এবং ত্রিশাল থেকে দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। নান্দনিক নকশা খচিত দ্বিতল বাড়িটি পড়ে রয়েছে অযত্নে-অবহেলায়।

জানা যায়, ভারতের সর্ববৃহৎ জেলা ময়মনসিংহের দক্ষিণ অঞ্চল পরিচালিত হতো বৈলর জমিদার বাড়ি থেকে। তখন থেকেই ত্রিশালের বৈলর প্রসিদ্ধ ছিল।

বৈলর নামকরণ হয় জমিদারি আমলে। এর নামকরণের কারণ হলো ময়মনসিংহ দক্ষিণের বৈলরের লোকজন তৎকালীন লেখাপড়া করার বেশি সুযোগ পেত। তখনকার লোকজন বই একটার পর একটা লর বেঁধে রাখত তাই বইয়ের লর কথাটি পরবর্তীতে বইলর হয়ে যায়। আর এই অঞ্চলের নামকরণ করা হয় বৈলর নামে।পরগণা জমিদারি স্টেট তথ্য অনুসারে, জমিদারের সঙ্গে গোটা রাজ্য পরিচালনার জন্য বৈলরের বেশ কয়েকজন বংশপরম্পরায় জমিদারদের সঙ্গে নিযুক্ত ছিলেন। বৈলরের সর্বশেষ জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরীর সঙ্গে একান্তভাবে জড়িত ছিল ত্রিশাল উজান বৈলরের কাদির বক্স সরকার ও তরিপ উল্লাহ সরকার অন্যতম বর্তমান তরফদার বংশের পূর্বপুরুষ।

তারা জমিদারের রাজ্য পরিচালনা, দলিল লিখন ও রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনা করত। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আশঙ্কায় জমিদার হেমচন্দ্র চৌধুরী দেশ ছেড়ে কলকাতা চলে যাওয়ার সময় তার কাছ থেকে তারা বিপুল পরিমাণ সম্পদ কেনেন, এমনকি হেমচন্দ্রের প্রিয় বৈলর জমিদার বাড়ি কেনেন।

কাঠের তৈরি এই দ্বিতল বাড়িটি ছিল সুনিপুণ নকশা ও কারুকাজের এক নিদর্শন । এ রাজবাড়িতে দশটি মহল, নাট্যঘর, রংমহল, কারাগারসহ ছিল বেশ কয়েকটি লৌহ সিন্দুক ও ভূমি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। এছাড়াও বাড়িতে জৌলুশ আসবাবপত্রসহ ছিল নানান প্রাণীর সংগ্রহশালা চিড়িয়াখানা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, জমিদার হেমচন্দ্রের কাঠের তৈরি ‘রংমহল’ তথা রাজবাড়ী পড়ে আছে অযত্নে-অবহেলায়।

জমিদারের রাজ্য পরিচালনা, দলিল লিখন ও রাজস্ব আদায়ের কাজ পরিচালনা করতেন। বর্তমান তরফদার বংশের পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকারীরা ভোগদখল করছেন।

রাজবাড়ীতে প্রবেশের একটি স্টিলের গেট রয়েছে অনেক ডাকাডাকির পর একজনকে পাওয়া গেল। তিনি বর্তমান তরফদার বংশের আবুল মহসিন তরফদারের ছেলে বোরহান উদ্দিন তরফদার ও শরিফ উদ্দিন বকুল তরফদার উত্তর আধিকার সূত্রে এই রাজবাড়ীতে বসবাস করেন।

জমিদার হেমচন্দ্রের কাঠের তৈরি দ্বিতল ‘রংমহল’ রয়েছে আগের মতোই কিন্তু তেমন কোনো আসবাবপত্র চোখে পড়েনি। হেমচন্দ্র যে ঘরে বাস করতেন সে ঘরে একটি খাট রয়েছে। যে বারান্দায় বসে থাকতেন তার সৌন্দর্যও রয়েছে। দোতলায় ওঠার কাঠের সিঁড়িটাও বিদ্যমান। কিছু জিনিস থাকলেও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।

জমিদার বাড়িতে বসবাসরত বোরহান উদ্দিন তরফদার বলেন, আমার বাব-দাদারা জমিদারের কাছ থেকে জমিদার বাড়িসহ পুকুর, জায়গা ক্রয় করে। জমিদার বাড়ি ৩ একর ২০ শতক জায়গায়, সব মিলিয়ে ৫০ বিঘা তথা ১০ একর জায়গা আছে এখানে।

এ জমিদার বাড়িতে প্রায় ৫৭ বছর ধরে বসবাস করছি। জমিদার আমলে রেখে যাওয়া এ বাড়িটি মানুষ রংমহল নামে চেনে। এ জমিদার বাড়িটি কিছু স্মৃতি ধরে রাখার চেষ্টা করছি। আমি একাই এ বাড়িতে থাকি জমিদারের আদি নিদর্শনগুলো রেখে কিছু কাজ করে থাকার উপযুক্ত করেছি। কাঠ দিয়ে তৈরি দ্বিতল ভবনে জমিদার দুতলায় থাকতেন তার রুম এখনো রয়েছে। অনেক পুরাতন হওয়ার ফলে অনেক অংশই জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। জমিদার বাড়ির ৩০ ইঞ্চি বিশিষ্ট দেয়াল, জলসা ঘর, পুকুর, নাট্যঘর ইত্যাদি অনেক কিছু রয়েছে।

২০০৩ সালে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক সফিকুল ইসলাম অতীত ঐতিহ্যের জমিদার বাড়ি সংরক্ষণার্থে অবৈধ দখলকার শরিফুল ইসলাম তরফদার বকুলকে নোটিশ প্রদান করেন। সরকারি জমি ও স্থাপনার অবৈধ দখল ত্যাগ না করায় দখল পুনরুদ্ধারে প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুজ্জামানকে নিয়োজিত করে শরিফুল ইসলাম তরফদার বকুলকে উচ্ছেদের জন্য নির্দেশ দেন। সরকারি ওই সম্পত্তি এখনো উদ্ধার না হলেও আদালতে চলছে মামলা।

Post a Comment

0 Comments