দেশভাগের স্মৃতিবিজড়িত রহস্যময় লক্ষ্মী ভিলা
বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলির- পুরান ঢাকা। সেসব গলিঘুঁজি ধরে হাঁটা মানে যেন ঐতিহ্যবাহী এ শহরের স্মৃতির সরণি বেয়ে অজানার পথে এগিয়ে চলা। কত কালের সাক্ষ্য, কত দিবারাত্রির কাব্য মিশে আছে এসব অলিগলির নানা দালানে, তা ভাবতে ভাবতে হারিয়ে যাওয়া সুদূর অতীতে। শতবর্ষী একেকটা দালানের নোনা-ধরা দেয়াল দিয়ে, খোলা বারান্দা দিয়ে, আলো-আঁধারির জানালা দিয়ে হাতছানি দেয় রহস্য।
সেই রহস্যের টানে, এসব পুরনো রাস্তা ধরে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়ানোর নেশায়, বহুবার খুঁজে পেয়েছি হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের হদিস। শুধু কি ইতিহাস, সে যেন সাত রাজার ধন মানিক রতন। কিছুদিন আগে তেমনই এক নিরুদ্দেশ যাত্রার ফাঁকে পেয়ে যাই রহস্যময় এক বাড়ির দেখা।
সেদিন বাংলাবাজারের বইয়ের দোকানগুলো দেখতে দেখতে হেঁটে যাচ্ছিলাম ফরাশগঞ্জের দিকে। ১৭৪০ সালের দিকে এই এলাকাতেই স্থায়ী বসতি গড়ে তুলেছিল এদেশে ব্যবসা করতে আসা ফ্রেঞ্চ বা ফরাসি নাগরিকেরা। সেই ফরাসি থেকেই 'ফরাস' আর বাজারের প্রতিশব্দ 'গঞ্জ' মিলে এলাকার নামকরণ হয়েছিল ফরাশগঞ্জ। এখানকার প্রাচীন বাড়িগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে তাই ফরাসি ঐতিহ্যের ছাপ লক্ষণীয়।
বুড়িগঙ্গার পাড় ঘেঁষে থাকা ফরাশগঞ্জের রাস্তার দুই ধারে যাবতীয় মশলা আর শুকনো বাজারের আড়ত। আলু, পেঁয়াজ, হলুদের বস্তার ঝাঁঝালো গন্ধ আর শুকনো মরিচের ঝাল নাকে-মুখে এসে লাগছিল হাঁটতে হাঁটতেই। পড়ন্ত দুপুর বেলাতেও পিকআপ ভ্যানে মালামাল তোলার ব্যস্ততায় রাস্তা জুড়ে ছিল জ্যাম। রাস্তার নাম বি কে দাস লেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে বসন্ত কুমার দাস নামের এক ব্যবসায়ী বরিশাল থেকে এসে বুড়িগঙ্গার পাড়ে এই এলাকায় গড়ে তুলেছিলেন তার আবাস। ব্যবসায় প্রসিদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পরোপকারী হিসেবেও ছড়িয়ে পড়েছিল তার নামডাক। পরবর্তীতে এই রাস্তার নামকরণও হয় তার নামেই।
বি কে দাস লেনের জনারণ্যের এক পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে লালকুঠি, রূপলাল হাউজ, বিবি কা রওজার মতো স্থাপনাগুলো পেরিয়ে সামনে এগিয়ে চোখে পড়ে ঝুলন্ত বারান্দাওয়ালা হলদেটে সেই বাড়ি। দরজা, জানালা বন্ধ। বাড়ির আঙ্গিনায় নিচু রডের বেড়া দিয়ে আগলানো। সামনের ছোট্ট গেটও তালাবদ্ধ। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল, দীর্ঘদিন ধরেই এখানে আবাস নেই কারো।
দালানের মাথায় ভগ্নপ্রায় দশায় চোখে পড়ে ১৯১১ লেখা। শত বছরের পুরনো আশ্চর্য সুন্দর এই স্থাপনা এভাবে পড়ে আছে ভেবে মনে আগ্রহ দানা বাঁধল আরও বেশি করে। দেখতে পেলাম বাড়ির পাশেই লাল দালানের মসজিদ, মসজিদের পাশেই আরেকটা বেশ পুরনো স্থাপনার ভাঙা বাড়ি।
ব্রিটিশ আমলে কোনো এক হিন্দু জমিদারের বাড়ি ছিল এটা। পাকিস্তান আমলে কলকাতার এক মুসলিম পরিবারের সাথে মালিকানা বদল হয় বাড়িটির। বর্তমান মালিক হোসেন পরিবারের কেউ আর এখানে থাকেন না। সামনের মূল দালানটির হল ঘরে আগে জনতা ব্যাংকের অফিস ছিল। প্রায় ১৭ বছর আগে উঠে গেছে সেই অফিসও। সেই দালানে এখন আর কেউ না থাকলেও পেছনের দুই-তিন তলা দালানে ভাড়া থাকে প্রায় ১৫টির মতো পরিবার।
বর্তমানে অভিভাবকহীনতায় ভুগছে বাড়িটি। ছাদ থেকে প্রায়ই পলেস্তারা খসে পড়ে, বর্ষার মরসুমে ভিজে ওঠে ছাদ আর দেয়াল। মূল মালিক মারা যাওয়ার পর তার তিন ছেলেই দেখাশোনা করতেন এটি। বড় ছেলে প্রতি শুক্রবার এসে নামাজ পড়তেন বাড়ির সামনের মসজিদে। বাড়ির খুঁটিনাটি সব কিছুর তদারকি করতেন নিজেই। বর্তমানে তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। তাই মালিকপক্ষের কেউ আর সরাসরি এসে দেখাশোনা করতে পারছেন না। কেয়ারটেকার আর ম্যানেজারের হাতেই ন্যস্ত গোটা বাড়ির দায়ভার।
ইট, কাঠ, শাঁখা আর কাপড়ের ব্যবসা ছিল বসন্ত কুমারের। বিশ শতকের শুরুতে বসন্ত কুমারের ব্যবসার যখন বেশ জমজমাট অবস্থা তখনই গড়ে তুলেছিলেন এই বাড়িটি। ২০১৯ সালে তৈমুর ইসলামের সহায়তায় গার্ডিয়ান পত্রিকায় এই লক্ষ্মী ভিলার ইতিহাস নিয়ে লিখেছিলেন জেনি গুস্তাফসন। তার লেখায় জানা গেল আরো বিস্তারিত।
'৪৭-এর দেশভাগের সময় পাকিস্তানের হিন্দু আর ভারতের মুসলিমদের অবস্থা ছিল শোচনীয়। বংশপরম্পরার তল্পিতল্পা গুটিয়ে হিন্দুরা পালাচ্ছিলো পাকিস্তান ছেড়ে আর মুসলিমরা পালাচ্ছিল ভারত ছেড়ে। সে সময়েই বসন্ত কুমারের পরিবারের সাথে আসরারুল হোসেনের পরিবারের চুক্তি হয় বাড়ি অদলবদলের।
আসরারুল হোসেন ছিলেন তৎকালীন কলকাতার নামকরা ব্যারিস্টার। এক মামলার সূত্রেই তার পরিচয় হয়েছিল দাস পরিবারের সাথে। সেসময় বসন্ত কুমারের বংশধররা থাকতেন এই বাড়িতে। পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৫০ সালের দাঙ্গায় বসন্ত কুমার দাসের পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয় খুব। এরপরই দেশ ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
'আমার দাদা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত রাজি ছিলেননা পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে যেতে, কিন্তু আমরা বাধ্য হয়েছি,' লেখক জেনি গুস্তাফসনকে বলেছিলেন বসন্ত বাবুর প্রপৌত্র অঞ্জন কুমার দাস।
বসন্ত কুমার দাসের লক্ষ্মী ভিলা ছিল স্থাপত্যশৈলী আর জাঁকজমকে আভিজাত্যপূর্ণ এক বাসস্থান। বিশাল হল ঘরে দামি সব আসবাবপত্রের পাশাপাশি ছিল বিলিয়ার্ড খেলারও ব্যবস্থা। জাঁকজমকের দিক দিয়ে হোসেনদের কলকাতার বাড়ি এর ধারেকাছেও ছিল না। তবে কলকাতার অভিজাত এলাকা পার্ক সার্কাসের পাশেই শেক্সপিয়ার সরণিতে অবস্থান ছিল সেটির। তখনকার ধনী আর্মেনীয়রা থাকতেন সেখানে।
বাড়ি বদলের চুক্তি অনুযায়ী আসরারুল হোসেন তার পরিবার নিয়ে লক্ষ্মী ভিলায় স্থিতু হলেও দাস পরিবার কলকাতার সেই বাড়ির দখল পাননি কোনোদিন। তৎকালীন উভয় দেশের সরকার দেশ ছেড়ে যাওয়া মানুষদের বাড়িঘরকে 'শত্রু সম্পত্তি' হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। অনেক বছর বাড়ির মালিকানা নিয়ে আইনি লড়াই চালিয়েও বাড়ির অন্দরে জায়গা করে উঠতে পারেননি তারা। পরবর্তীতে অন্য জায়গায় বহুতল কমপ্লেক্স নির্মাণ করে বসবাস শুরু করেন তারা।
বেশ কয়েকবছর সপরিবারে লক্ষ্মী ভিলায় থাকার পর আসরারুল হোসেন বাড়িটিকে তার ল' ফার্মের অফিসে পরিণত করেন। আর অন্যান্য ঘরগুলো ভাড়া দিয়ে দেন বেশ কয়েকটি পরিবারের কাছে।
আসরারুল হোসেনের ছেলে আজমালুল হোসেন গুস্তাফসনকে জানিয়েছিলেন বাড়িটি সংস্কার করার চিন্তাভবনা করছেন তিনি। দাস পরিবার কলকাতা চলে যাওয়ার সময় বেশীরভাগ আসবাবপত্র নিয়ে গেলেও কিছু কিছু পড়ে ছিল বাড়িতেই। তার মধ্যে ১৫টির মতো দামী ঝাড়বাতি ঝোলানো ছিল হলরুমে। এত বছরে বানরের আক্রমণে যেগুলো ভেঙে চৌচির হয়েছে।
ফরাশগঞ্জের ৭৯ নং ওয়ার্ডের ৪৭ নং এই বাড়িটির নাম যে লক্ষ্মী ভিলা ছিল তা এই এলাকার কেউ আর এখন জানেন না। আদি মালিক সম্পর্কে ভাসা ভাসা তথ্যে একে জমিদার বাড়ি বলেই ভাবেন অনেকে। বাড়ির বাসিন্দারা প্রায়ই গুঞ্জন শোনেন ভেঙে ফেলা হবে এই দালান। বহুদিন সংস্কারের অভাবে বাড়ির সামনের ঝুলন্ত বারান্দায় ক্ষয় চোখে পড়ে। তবু সৌন্দর্যপিপাসু পথিকের মনে সহসাই কৌতূহল জন্মাতে এখনো ক্ষান্ত হয়নি লক্ষ্মী ভিলার রূপ।
তথ্যসুত্র : দ্যা বিজনেস ষ্ট্যাণ্ডার্ড/ শেহেরীন আমিন সুপ্তি
0 Comments
If you have any doubts or questions, let me know.